টেকনাফ বন্দরের সেই নুরুলের স্ত্রীর তিনশ কোটি টাকার বেশি সম্পদ: সহায়তায় ছিলেন যারা!

শাহাদাত হোসেন পরশ,সমকাল :

২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত টেকনাফ স্থলবন্দরে মাসিক মাত্র চার হাজার টাকা বেতনের সাধারণ এক কর্মচারী ছিলেন নুরুল ইসলাম।

সেখানেই স্থানীয় পুরান পল্লানপাড়ার বাসিন্দা মৃত আবদুল আহামদের মেয়ে রাজিয়া ইসলামের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। এক পর্যায়ে রাজিয়াকে বিয়ে করেন তিনি। তারপর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই নুরুলের সাধারণ গৃহিণী রাজিয়া মালিক হয়েছেন ৩০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের।

ঢাকায় রাজিয়ার নামে রয়েছে একাধিক অট্টালিকা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। দেশের বিভিন্ন জায়গায়ও জমি কিনেছেন তিনি। সাভারে বিশাল জায়গাজুড়ে তিনি শিশু পার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিলেন। নুরুল-রাজিয়া দম্পতি কোটি কোটি টাকার মালিক হলেও সম্পদ বিবরণীতে তার অধিকাংশই গোপন করেছেন।

গত সোমবার রাতে মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন নুরুল ইসলাম। মোহাম্মদপুর থানায় তার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইন ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা হয়েছে। গতকাল রাতে তাকে এক দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে নুরুল ইসলাম দম্পতি কোথায় কী কী সম্পদ গড়েছেন, সেসবের হিসাব। আদাবর নবোদয় হাউজিংয়ে ডি-ব্লকে বাড়ি রয়েছে তাদের। সাত কাঠা জমির ওপর সাততলাবিশিষ্ট এ বাড়ির মূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। ঢাকা উদ্যানে চার মাথার মোড়ে একটি বাড়ির মালিক তারা। সাড়ে চার কাঠা জমির ওপর নির্মিত এ সাততলা বাড়ির মূল্য আনুমানিক ১০ কোটি টাকা।

ঢাকা উদ্যানের একতা হাউজিংয়েও বাড়ি রয়েছে তাদের। ৯ কাঠা জমির ওপর নির্মিত ওই বাড়ির বাজারমূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। বাড়ির নিচে ১৭টি দোকানও রয়েছে। ঢাকা উদ্যানে হাজি দীল মোহাম্মদ সড়কে ১১ কাঠা জমির ওপর দোতলা বাড়ি গড়ে তুলেছেন তারা। বাড়ির নিচতলায় দিয়েছেন দোকান ভাড়া। এ সম্পদের মূল্য ১৭-১৮ কোটি টাকা। ঢাকা উদ্যানের ডি-ব্লকের ২ নম্বর রোডে রয়েছে পৌনে চার কাঠা জমি।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আমিনবাজারের বরদেশী মৌজায় সিলিকন রিয়েল সিটিতে ২০ দশমিক ৬১ কাঠা জমি আছে নুরুল ইসলামের। মোহাম্মদপুরের চন্দ্রিমা মডেল টাউনে বি-ব্লকের ৭ নম্বর রোডের একটি প্লটের মালিক তারা। দোতলা ভবনসহ ওই জমির মূল্য প্রায় চার কোটি টাকা। ঢাকা উদ্যান এলাকার একতা হাউজিং লিমিটেডের ৬ নম্বর রোডের একটি বাড়িও তাদের। সাড়ে চার কাঠা জমির ওপর নির্মিত ওই বাড়ির দাম প্রায় চার কোটি টাকা।

ঢাকা উদ্যানের বি-ব্লকের ২ নম্বর রোডের একটি প্লটে আট কাঠা জমির ওপর রিকশার গ্যারেজ ও ঘর আছে এ দম্পতির। একতা হাউজিংয়ের দ্বিতীয় প্রকল্পে ডি-ব্লকের ৪ নম্বর রোডে রয়েছে আট কাঠা জমির একটি প্লট। একই হাউজিংয়ের ডি-ব্লকের ৩ নম্বর রোডের একটি প্লটে সাড়ে চার কাঠা জমির ওপর রিকশার গ্যারেজ করেছেন এ দম্পতি। একই হাউজিংয়ের একই ব্লকে চার কাঠার আরেকটি প্লট রয়েছে তাদের। মোহাম্মদপুরে চন্দ্রিমা মডেল টাউনে বি-ব্লকে দুটি প্লটের মালিক তারা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, টেকনাফ সদরের লেঙ্গুরবিল এলাকায় এ দম্পতি ১১০ দশমিক ৪২ শতাংশ জমি কিনেছেন, যার মূল্য ৮-৯ কোটি টাকা। সাবরাংয়ে ৩৩ দশমিক ১৩ শতাংশ জমি আছে তাদের। জিঞ্জিরা দ্বীপে রয়েছে ২০ শতাংশ জমি। মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর মৌজায় ৪৭ দশমিক ২৫ শতাংশ জমি রয়েছে তাদের। নুরুলের গ্রামের বাড়ি ভোলা সদরে রয়েছে পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের ২৬ শতাংশ জমি। একই এলাকার আরেক মৌজায় রয়েছে ৩২ শতাংশ জমি। এ ছাড়া রয়েছে আমিনবাজারের বরদেশীতে ৩৪ শতাংশ জমি। একই এলাকার আরেকটি মৌজায় ৪১ দশমিক ২৫ শতাংশ জমি; পাশেই আরেকটি ৮০ দশমিক ৭৫ শতাংশ জমি। মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর মৌজায় রয়েছে রাজিয়ার নামে দশমিক ৫৭ একর জায়গা, যার বাজারমূল্য ১৭-১৮ কোটি টাকা। একই মৌজায় রয়েছে রাজিয়ার আরও ২ দশমিক ১ একর জায়গা, যার বাজারমূল্য ৭০-৭৫ কোটি টাকা। তার নামে আরও দশমিক ৫৫৬ একর জায়গা রয়েছে এই এলাকায়। এর মূল্য ১৭-১৮ কোটি টাকা। টেকনাফের লেঙ্গুরবিল এলাকায় রাজিয়ার নামে থাকা দশমিক ২০ একর জায়গার মূল্য তিন থেকে চার কোটি টাকা। আমিনবাজারের বরদেশী এলাকায়ও রাজিয়ার নামে ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ জমি রয়েছে, যার মূল্য প্রায় সাত কোটি টাকা। এ ছাড়া মোহাম্মদপুর ও টেকনাফের আরও দুটি মৌজায় তার জমি ও প্লট থাকার নথিপত্র মিলেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, একসময় এই দম্পতির সংসারে আর্থিক অনটন লেগে থাকত। নুরুলের বাবা ছিলেন রাজমিস্ত্রি। তার সহযোগী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ২০০১ সালে কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দরে দৈনিক চুক্তিভিত্তিক ১৩০ টাকা মজুরিতে কম্পিউটার অপারেটরের চাকরি নেন তিনি। ২০০৯ সাল পর্যন্ত আট বছর করেছেন সে চাকরি। এরপর ওই পদে বসান তার সৎভাই রনি ইসলামকে। নুরুল নিজে টেকনাফকেন্দ্রিক একটি বড় সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন ও রাতারাতি কোটি টাকার মালিক হন। এমনকি গৃহিণী স্ত্রী রাজিয়ার নামেও কোটি কোটি টাকার সম্পদ কেনেন তিনি। প্রসঙ্গত, রাজিয়ার বাবা টেকনাফে একসময় মাত্র ৪ শতাংশ জমির মালিক ছিলেন।

সূত্রমতে, এ দম্পতির সম্পদ বিবরণীতে মাত্র পাঁচ কোটি ৯৪ লাখ ৩৪ হাজার ৯৬০ টাকার হিসাব দেখানো হয়েছে। ৪৫৪ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন তারা। বাবুল মিয়া নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে নুরুল তার অধিকাংশ জায়গা-জমি কিনেছেন। তার অনৈতিক কারবারে সহায়তা করেছেন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাহজাহান মিয়া। এ ছাড়া স্থলবন্দরের শুল্ক্ক কর্মকর্তা আবছার উদ্দিনের সঙ্গেও তার আর্থিক বিষয়ে ‘ভালো সম্পর্ক’ রয়েছে। অবৈধ পথে আয় করা কোটি কোটি টাকার সম্পদকে ‘হালাল’ করতে এমএস আল নাহিয়ান এন্টারপ্রাইজ, এমএস মিফতাউল এন্টারপ্রাইজ, এমএস আলকা এন্টারপ্রাইজ, আলকা রিয়েল এস্টেট লিমিটেড, এমএস কানিজ এন্টারপ্রাইজ ইত্যাদি নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, নুরুল অনেক সম্পদ তার স্ত্রীর নামেও কিনেছেন। আরও নতুন কিছু ব্যবসায় অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা ছিল তার। সাভারে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শিশু পার্ক তৈরি করতে জমিও কিনেছেন। তিনি ও তার স্ত্রী যেভাবে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন, তা বিস্ময়কর।